আয়া থেকে শত কোটি টাকার মালিক মুক্তা রাণী


ডেইলি নিউজ প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪, ৫:০৪ অপরাহ্ন /
আয়া থেকে শত কোটি টাকার মালিক মুক্তা রাণী
স্বামী মারা যাওয়ার পরে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েন মুক্তা রাণী রায়। তার চাচাতো ভাই দুলালের মাধ্যমে আয়া পদে চাকরি নেন সিভিল সার্জন অফিসে। চাকরিরত অবস্থায় তার সখ্যতা গড়ে ওঠে  ঠাকুরগাঁও-১ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের সঙ্গে। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মুক্তা রাণীকে।
চার বছর আয়া পদে চাকরি করার পর ছেড়ে দেন। এরপর মুক্তা রায় এমপি রমেশ চন্দ্র সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচিতি পান। মুক্তা রাণী থেকে নাম পরিবর্তন করে হয়ে ওঠেন মুক্তা সেন। ধীরে ধীরে শুরু হয় মুক্তা সেনের উত্থান।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের চণ্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তা রাণী। কোর্টে মুহুরি হিসেবে কর্মরত ছিলেন তার স্বামী। যা আয় হত তা দিয়ে সংসারে সবসময় ছিল টানাপোড়েন। স্বামী মারা যাওয়ার পরে দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আয়া পদে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। পরে আয়া পদ থেকে চাকরি ছেড়ে যোগ দেন ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাসপাতালের কেনাকাটা, খাবার, আউটসোর্সিং-এ নিয়োগ বাণিজ্য করে আঙুল ফুলে যেন কলাগাছ হয় তার।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মুক্তা রায়ের ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, রেন্ট এ কারের শো-রুম, ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের ইসলামবাগে দুই তলা বাড়ি, শান্তিনগরে দুই জায়গায় প্লট আকারে ৫ শতক করে জমি, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলএসডি গোডাউনের পাশে ১০ শতক জমি, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পাশে 3PM নামে একটি রেস্টুরেন্ট, সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বাদুপাড়ায় বাড়ি-জমি ও সয়াবিন তেলের কারখানা, চন্ডিপুরে বাড়ি, মিল-চাতাল ও পুকুর এছাড়া আবাদি জমি রয়েছে ২০ বিঘা। সদরের গড়েয়া বাসস্ট্যান্ডে ৮ শতক জমির ওপরে বাড়িও রয়েছে মুক্তার। এছাড়া তিনি নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখলসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি ও বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার রয়েছেন। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের নওগাঁর অটো রাইস মিল কয়েক কোটি টাকায় কিনেছেন এই মুক্তা।
চলতি বছরে মুক্তার দুই ছেলে তূর্য ও মাধুর্য এন্টারপ্রাইজ নামে পূবালী ব্যাংক হিসাব নম্বরে লেনদেন হয়েছে ২০ কোটি ৩৮ লাখ ২০৯৯ টাকা। সাবেক মন্ত্রী ও এমপি রমেশ চন্দ্র সেন আটক হওয়ার পর দিন সব টাকা তুলে নেন তিনি। বর্তমানে তার ছেলে তূর্যের অ্যাকাউন্টে রয়েছে ৬ হাজার ৪১৭ টাকা। এছাড়া জনতা, অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকে তাদের হিসাব নম্বরে গত দুবছরে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
ভাইদের রাজনীতিতে যুক্ত করে ঠিকাদারি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিয়েছেন মুক্তা রাণী। ভাতিজা-ভাতিজিদের সরকারি চাকরিও নিয়ে দিয়েছেন তিনি।
হত্যা মামলায় ভারতে পলাতক থাকা বড় ভাই নারায়ণ ঠাকুরকে এসে যুক্ত করান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। মন্ত্রীর প্রভাব আর রাজনৈতিক দাপটে তারা হয়ে ওঠেন আরও প্রতাপশালী। তার খালাতো ভাই দুলালকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খালাতো বোনের ছেলে নিপুণকে হাসপাতালের ঠিকাদারি, বোনের মেয়ে মৌকে স্কুলের শিক্ষিকা, আরেক বোনের ছেলে জয়কে রাজস্ব ও আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি দিয়েছেন তার দুই শতাধিক আত্নীয়-স্বজনকে।
মুক্তা রাণী রায়ের খালাতো ভাই ফণি রায় বলেন, সবাই আমাকে বলে মন্ত্রী নাকি আামার ভগ্নিপতি। আমি বলি, বিয়ে তো খেলাম না। মুক্তার পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতো। পরে নিজে বাড়ি কিনেছে। আমাদের অনেক আত্নীয়-স্বজনকে চাকরি নিয়ে দিয়েছে। এলাকায় কিছু জমিও কিনেছে।
আরেক বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা সবাই তাকে এমপির দ্বিতীয় বউ হিসেবে চিনতাম। এলাকায় জমি, তার ভাই ও বোনসহ আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন। তাদের বংশের সবার চাকরি হয়েছে। এলাকার স্কুলগুলোতে অনেককে চাকরি দিয়েছে। চাকরির বিনিময়ে টাকা নিয়েছে আবার কারো কাছে জমিও নিয়েছে। পাশেই মিল-চাতাল পুকুর ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় কেনার জন্য ৩০ লাখ অগ্রীম টাকাও দিয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে মুক্তা রাণীর মোবাইলে বারবার কল করা হলেও নাম্বারটি বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ বলেন, ২০১০ সালে মুক্তা রাণী আয়া পদে যোগদান করেন। পরে ২০১৪ সালে তিনি সেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঠাকুরগাঁও সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক তাহসীন মুনাবীল হক বলেন, আয় বহির্ভূত সম্পদ উপার্জনের কোনো সুযোগ নেই। কেউ এসবে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।